প্রবাহ ডেস্ক: পর্যাপ্ত লোকোমোটিভ ও স্পেয়ার পার্টসের অভাবে সারা দেশে ট্রেন চলাচলে প্রায়ই বিঘ্ন ঘটছে। গত জুন মাসের শেষ ১৫ দিনে অন্তত ৩৭টি ট্রেনের ইঞ্জিন মাঝপথে বিকল হয়ে যায়। জুলাইয়ে ২২ টি ইন্জিন বিকল হয় মাঝপথে আর আগস্টের হিসাব এখনো পাওয়া না গেলেও জানা গেছে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ট্রেনের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটছে। জোড়াতালি দেওয়া এমন সেবায় উদ্বেগ জানিয়েছেন রেলের রানিং কর্মচারীসহ খোদ লোকোমাস্টাররা। তাদের আশঙ্কা, এমন অবস্থা চলতে থাকলে গোল্লায় যাবে রেল সেবা ও যেকোনো সময় বসে যাবে রেল। অর্থাৎ বিপর্যয় নেমে আসবে এই সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে রেলসেবার বেহাল দশায় ক্ষুব্ধ রেলের যাত্রীরা। তারা দ্রুত এসব ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ চান। বিপরীতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কেবল দুঃখ প্রকাশ করে দায় সারছেন। কারন তাদের কিছুই করার নাই।তারাও জিম্মি নীতি নির্ধারকদের নিকট।
গত ৯ আগস্ট বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে আন্তঃনগর জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ভূয়াপুর থেকে ছেড়ে যায়। শিডিউল অনুযায়ী রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা ছিল এটির। কিন্তু ট্রেনটি পৌঁছায় পরদিন ১০ আগস্ট ভোর ৬টায় রাত ৮টার দিকে জামালপুর জংশন ছাড়ার পর ট্রেনটির ২৯১৭ নম্বর লোকোমোটিভের দুই ট্র্যাকশন মোটরের একটিতে আগুন ধরে যায়। ফলে ট্রেনটি ফের জংশনে ফিরে আসে। পরে ময়মনসিংহ থেকে অন্য একটি লোকোমোটিভ এনে রাত সাড়ে ১০টায় ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে পুনরায় ছেড়ে যায়। এতে যাত্রীরা প্রায় ৬ ঘণ্টা বিলম্বের শিকার হন।
যাত্রীরা বলছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেন পরিচালনা করতে চায় না বা কোরতে পারছেননা। না হলে একটি অপারেশনে এত ব্যর্থতা কীভাবে থাকবে? প্রায়ই শোনা যায় যাত্রাপথে ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট। ট্রেন বিলম্বিত হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই। এভাবে কতদিন চলবে?
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২৯১৭ নম্বর লোকোমোটিভটি ২০০৪ সালে বহরে যুক্ত হয়েছিল, যেটির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে এক বছর আগে। উদ্ধারকারী ২৯০১ নম্বর লোকোমোটিভটি ১৯৯৯ সালে বহরে যুক্ত হয়েছিল, যেটির আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে ছয় বছর আগে।
সরকারি তথ্য বলছে, বর্তমানে সারা দেশে প্রতিদিন অন্তত একটি ট্রেনের লোকোমোটিভ ফেইলের ঘটনা ঘটছে, যা যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলছে। গত জুন মাসের শেষ ১৫ দিনে সারা দেশে ৩৭টি ট্রেনের লোকোমোটিভ ফেইল হওয়ার রেকর্ড হয়েছে আর জুলাই মাসে রয়েছে ২২ টি। এমন ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, বর্তমানে সারা দেশে ট্রেন চালাতে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০৫টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন হয় বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ১০৫টি মিটারগেজ ও ১০০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ দরকার। কিন্তু সবমিলিয়ে মাত্র ১৬০ থেকে ১৭০টি লোকোমোটিভ রয়েছে রেলওয়ের স্টোরে। এগুলো দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে আধা সচল রাখা হয়েছে। ফলে বিশ্রামহীন লোকোমোটিভগুলো প্রায়ই যাত্রাপথে বসে বিকল হচ্ছে।
জামালপুরের ঘটনায় ভূগতোভোগী যাত্রীরা বলেন, বছরের পর বছর আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়া লোকোমোটিভ দিয়ে আন্তঃনগর ট্রেন চালানো মানে যাত্রীদের সঙ্গে চূড়ান্ত অবহেলা করা আর যাত্রীদের সাথে সেবা সেবা খেলা করা। পুরো রাত ট্রেনে নির্ঘুম কাটিয়েছে সকল যাত্রী। সকাল থেকে অফিসও করতে হয়েছে তাদের। পুরো যাত্রাটাই হয়েছে চরম আতংক ও ভোগান্তির।
ভুক্তভোগী যাত্রী মনোয়ার হোসেন বলেন, আমার মনে হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেন পরিচালনা করতে চায় না, বা কোরতে পারছেন না। না হলে একটি অপারেশনে এত ব্যর্থতা কীভাবে থাকবে? প্রায়ই শোনা যায় যাত্রাপথে ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট। ট্রেন বিলম্বিত হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই। এভাবে কতদিন চলবে?
ঢাকা রেলভবনের প্রকৌকশলীরা বলেন, প্রতিদিন আমাদের অন্তত ১১০টি লোকোমোটিভ দরকার, কিন্তু হাতে থাকে মাত্র ৬০-৬৫টি। ফলে কোনো লোকোমোটিভই বিশ্রাম পায় না, চলতে থাকে টানা। এজন্য এগুলো পথের মাঝে বসে যায়। সে গুলো সচল করা হলে কয়েকদিন চলে। পরে আবার সমস্যা দেখা দেয়।
মাঝপথে ট্রেন থেমে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো লোকোমোটিভ জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা। স্পেয়ার পার্টস না পাওয়ায় এ ধরনের মেরামত করতে হয় বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের একাধিক প্রকৌশলী।
রেলওয়ে ভবন ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই ইঞ্জিন ফেইল হচ্ছে, অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা এটা নিয়ে আসলেই ঝামেলায় আছি। এই মুহূর্তে নতুন ইঞ্জিন কেনার প্রক্রিয়া নেই। পুরনো ইঞ্জিনগুলো দ্রুত মেরামত করতে হবে। স্পেয়ার পার্টস কিনতেও সমস্যা হচ্ছে। সবমিলিয়ে আমাদের স্পেয়ার পার্টসের ঘাটতি রয়েছে। উপদেষ্টা মহোদয় নির্দেশ দিয়েছেন, যেসব স্পেয়ার পার্টস কেনা সম্ভব সেগুলো দ্রুত কিনতে হবে। একটু সময় লাগবে। তারপরও যেভাবে দ্রুত কাজ হবে সেভাবে চেষ্টা করছি।
পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রীক প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান বলেন, পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা থেকে জেনারেল ওভারহোলিং (জিওএইচ) করে মাসে এক বা দুটি লোকোমোটিভ আনা যায়। বছরে হয় মাত্র ২০-২১টি। আমাদের ট্রেনের চেয়ে লোকোমোটিভের সংখ্যা কম। ট্রেন ঠিকভাবে চালাতে গেলে কিছু ট্রেন বন্ধ করতে হবে।
তিনি আরো জানান, পাওয়ার (লোকোমোটিভ) হলো এমন একটি মেশিন, যেখানে একটি সমস্যা হলে সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। স্পেয়ার পার্টসের অভাব আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পার্টস মিললেও তা লোকোমোটিভের সংখ্যা বাড়াবে না। নতুন লোকোমোটিভ কিনতেই হবে।
পথে ট্রেনের লোকোমোটিভ বন্ধ হয়ে গেলে যাত্রীদের রোষানলে পড়েন রানিং কর্মচারীদের সাথে লোকোমোটিভ মাস্টারেরা। একাধিক লোকোমাস্টার বলেছেন, বর্তমানে লোকোমোটিভগুলো প্রতিযোগিতা করে যাত্রাপথে বিকল হচ্ছে। অনেক সময় যাত্রীদের আক্রমনে আহত হচ্ছেন তারা।এমন অবস্থা চলতে থাকলে রেল যেকোনো সময় বসে যাবে।
লোকোমাস্টার এসোসিয়েসনের নেতারা বলেন, আগে মহানগর প্রভাতি ট্রেন চালাতো ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়ে, যা এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গত ১৫ দিন ধরে এই ট্রেন চালানো হচ্ছে পুরনো ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়ে। ফলে সবসময় সেকশন টাইম লস হচ্ছে এবং যাত্রীদের ভোগান্তি হচ্ছে। ২-৩টি ইঞ্জিন ছাড়া বাকি সব ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া বড় সমস্যা হলো চীন থেকে আনা কোচগুলো ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন ছাড়া চালানো যায় না। এই কোচগুলোর ওয়াশরুম সুবিধা ইঞ্জিনের সঙ্গে সংযুক্ত। ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন না থাকলে ওয়াশরুম ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এর মধ্যে আছে- কক্সবাজার এক্সপ্রেস, পর্যটক এক্সপ্রেস, মহানগর প্রভাতি ও গোধূলী ট্রেন।
পূর্বাঞ্চলের এক প্রকৌশলী বলেন, বর্তমানে ৩০০০ সিরিজের ১৩টি লোকোমোটিভ ঠিক আছে, বাকি ১৭টি কাজ করছে না। এর মধ্যে ২টি ডিজেলশপ থেকে ট্রায়ালে আছে।
আবুল কালাম আজাদ নামের একজন লোকোমাস্টার বলেন, ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনের পার্টস পাওয়া যাচ্ছে না। আগের যেসব ইঞ্জিন আছে, সেগুলোরও আয়ুষ্কাল শেষ। আগে এগুলো ভালো সার্ভিস দিত, কিন্তু এখন পুরনো হওয়ায় কার্যক্ষমতা কম।
তিনি বলেন, যাত্রীরা অনেকেই জানেন না, আমরা স্টেশন থেকে সিগনাল না পেলে ট্রেন চালাতে পারি না। তারা মনে করেন সব দোষ আমাদের। যাত্রাপথে ইঞ্জিন বন্ধ হলে আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়, অথচ আমাদের কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, প্রতিদিনই ইঞ্জিন ফেইল হচ্ছে, অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা এটা নিয়ে আসলেই ঝামেলায় আছি। এই মুহূর্তে নতুন ইঞ্জিন কেনার প্রক্রিয়া নেই। পুরনো ইঞ্জিনগুলো দ্রুত মেরামত করতে হবে। স্পেয়ার পার্টস কিনতেও সমস্যা হচ্ছে। সবমিলিয়ে আমাদের স্পেয়ার পার্টসের ঘাটতি রয়েছে।
উপদেষ্টা মহোদয় নির্দেশ দিয়েছেন, যেসব স্পেয়ার পার্টস কেনা সম্ভব সেগুলো দ্রুত কিনতে হবে। একটু সময় লাগবে। তারপরও যেভাবে দ্রুত কাজ হবে সেভাবে চেষ্টা করছি।
মহাপরিচালক যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, যাত্রীদের এই ভোগান্তির জন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। পথে বিলম্ব কারও কাম্য নয়। আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।