প্রবাহ ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হলো আসিয়ান-গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)-চীন সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন। চীনের দৃষ্টিতে এই বৈঠক শুধু কূটনৈতিক সৌজন্য নয় বরং গ্লোবাল সাউথের পাওয়ারের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
চীনের কাছে এই ত্রিপাক্ষিক বৈঠক নিছক প্রতীকী কোনো পদক্ষেপ নয়। বরং এটি এক নতুন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অক্ষের জন্ম দিচ্ছে, যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বাণিজ্য কাঠামোর বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে এবং সহযোগিতার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং আজ বলেছেন, চীন চায় আসিয়ান ও তেলসমৃদ্ধ জিসিসি সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারিক সহযোগিতা বাড়াতে, যেন সবাই মিলে নিজেদের শক্তি কাজে লাগিয়ে যৌথভাবে লাভবান হওয়া যায় এবং গ্লোবাল সাউথের অভিন্ন স্বার্থ রক্ষা করা যায়।
এই সম্মেলনে একত্রিত হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংহতির লক্ষ্যে আসিয়ানের প্রচেষ্টা, জিসিসির তেলনির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের লক্ষ্যে নেয়া পরিকল্পনা, আর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই, যা বৈশ্বিক পরিকাঠামো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে।
আসিয়ান চেয়ার হিসেবে মালয়েশিয়া এই প্রথম সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যেটি বহুপাক্ষিক সহযোগিতার এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। আসিয়ান, জিসিসি ও চীনের সম্মিলিত শক্তি এখন বিশ্ব অর্থনৈতিক গতিপথ আমূল বদলে দিচ্ছে।
আসিয়ান বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, সম্মিলিত জিডিপি ৩.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি এবং ৭০ কোটি মানুষের একটি উদীয়মান ভোক্তার বাজার।
মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী তেঙ্কু দাতুক সেরি জাফরুল আবদুল আজিজ জানিয়েছেন, ২০২৫ সালে আসিয়ানের সম্মিলিত জিডিপি ৪.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, যেখানে গত বছর তা ছিল ৪.২ শতাংশ।
অন্যদিকে, জিসিসি যাদের শক্তির মজুদ বিপুল এবং প্রায় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল রয়েছে, তারা সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার মাধ্যমে দ্রুত বৈচিত্র্য আনছে।
চীন, যার জিডিপি এখন ১৮.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, তাদের রয়েছে বিশাল শিল্প উৎপাদন ক্ষমতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং পরিকাঠামো নির্মাণে বিশেষ দক্ষতা।
এই তিনটি অঞ্চল মিলে এখন প্রায় এক-চতুর্থাংশ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং ২.১ বিলিয়নের বেশি ভোক্তা জনসংখ্যা নিয়ে গঠিত, যাদের আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
এই অংশীদারত্বের বিশেষত্ব হলো, এটি আদর্শভিত্তিক নয় বরং পারস্পরিক লাভের ভিত্তিতে গড়ে উঠছে। আসিয়ানের যুবপ্রধান জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদ চীনের উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে দারুণভাবে মেলে যায়, আর জিসিসির আর্থিক পুঁজি ও বৈচিত্র্যকরণের লক্ষ্য চীনের বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সবুজ শক্তি উদ্যোগের সঙ্গে মিল রেখে চলে।
এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাণিজ্য এরই মধ্যে তুঙ্গে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে চীন-আসিয়ান বাণিজ্য ১.৭১ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭.১ শতাংশ বেশি।
২০২৪ সালে চীন-জিসিসি বাণিজ্য ছিল ২৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যেখানে গালফ রাষ্ট্রগুলো চীনের ৪০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে। নীতি সমন্বয়ও দ্রুতগতিতে হচ্ছে।
সম্প্রতি চীন-আসিয়ান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট ৩.০ চূড়ান্ত হয়েছে, যেখানে ডিজিটাল বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়নে জোর দেয়া হয়েছে। একই সময়ে চীন-জিসিসি ফ্রি ট্রেড আলোচনা চলমান রয়েছে, যার লক্ষ্য বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য ব্লক গঠন।
এই সম্মেলনটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, আসিয়ানের কানেক্টিভিটি মাস্টার প্ল্যান ২০২৫ এবং জিসিসির ভিশন ২০৩০ এই তিনটি রূপান্তরমূলক উন্নয়ন কৌশলকে একসূত্রে বাঁধতে সহায়তা করছে।
যখন পশ্চিমা অর্থনীতিগুলো প্রতিরক্ষামূলক বাণিজ্যনীতির দিকে ঝুঁকছে, তখন আসিয়ান-জিসিসি-চীন অংশীদারত্ব একটি নতুন মডেল প্রস্তাব করছে, বৈচিত্র্য ও স্থিতিশীলতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক টিকে থাকার পথ।
২০২৩ সালে চীনের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে আসিয়ান যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে সৌদি আরবের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ৫.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মতো পদক্ষেপ চীনের প্রযুক্তি খাতে গালফ রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহ দেখাচ্ছে যা জ্বালানির বাইরেও গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।
চীনের ডিজিটাল সিল্ক রোড (ডিএসআর) উদ্যোগ এই অঞ্চলগুলোকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে চীনের সীমান্তপারের ই-কমার্সের মোট পরিমাণ ছিল ১.২২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৫ শতাংশ বেশি।
চীন এবং তার অংশীদাররা একত্রে একটি আরও সংযুক্ত ও টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলছে যেখানে উন্নয়ন ভাগ করে নেয়া হবে, দখল করা নয়। চীন প্রতিনিয়ত এ বিষয়টি তার রাষ্ট্রীয় প্রচারেও তুলে ধরছে।
আসিয়ান ও জিসিসির মতো, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গেও চীনের অংশীদারত্ব প্রমাণ করে যে, চীনের বৈশ্বিক সম্পৃক্ততা আদর্শ চাপ নয় বরং অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে গড়ে উঠছে।
আসিয়ান-জিসিসি-চীন সম্মেলন এক নতুন যুগের সূচক যেখানে গ্লোবাল সাউথ নিজেই বিশ্বনীতির রূপরেখা নির্ধারণ করবে।
বেইজিংয়ের দৃষ্টিকোণে এই সম্মেলন নিছক কোনও কূটনৈতিক ইভেন্ট নয় বরং এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি যেখানে গ্লোবাল সাউথ তাদের ন্যায্য অবস্থান নিশ্চিত করবে।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে এই সম্মেলনে অংশ নিতে যাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটি লির দ্বিতীয় সরকারি সফর মালয়েশিয়ায়। তিনি সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুনে মালয়েশিয়া সফর করেছিলেন চীন-মালয়েশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির উপলক্ষে।