মঙ্গলবার | ২রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ খবর :
`অপরাধবোধ ও বিবেকের তাড়নায় আমি রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’ রাজশাহীর আদিবাসি সাঁওতাল পল্লীতে কালোথাবা, ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পল্লী ছাড়তে হুমকি নুরের ওপর হামলায় জামায়াত জড়িত, নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে: ছাত্রদল নেতা আমান তারেক রহমানের ৩১ দফার বার্তা প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে হবে: বেগম সেলিমা রহমান নুরের ওপর হামলায় জড়িত কেউ রেহাই পাবে না, সরকারের বিবৃতি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন প্রতিহত করার কোনও শক্তি নাই: প্রেস সচিব ফজলুর রহমানকে গ্রেপ্তার দাবিতে বাসার সামনে অবস্থান রোহিঙ্গা সংকট, বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করা: জাতিসংঘ ফজলুর রহমানকে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দিলো বিএনপি হত্যা মামলায় রিমান্ডে আফ্রিদি, খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাবার ছবি দেখিয়ে জামিন চাইলেন আইনজীবী
রাজশাহীর আদিবাসি সাঁওতাল পল্লীতে কালোথাবা, ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পল্লী ছাড়তে হুমকি

রাজশাহীর আদিবাসি সাঁওতাল পল্লীতে কালোথাবা, ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পল্লী ছাড়তে হুমকি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী শহরের সাঁওতাল পল্লীতে শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন বেশ কিছু আদিবাসী সাঁওতাল পরিবার। ফলে এলাকাটি সাঁওতাল পল্লী হিসেবে পরিচিত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভিটেমাটি বুকে আগলে রেখেছেন তারা। কিন্তু সেই পল্লী এখন জবরদখল হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী সাজ্জাদ আলীর দখলচেষ্টায় উচ্ছেদের মুখে পড়েছেন তারা। এরই মধ্যে বেশ কিছু পরিবার অন্যত্র সরে গেছেন। বাকিদেরও আগামী শুক্রবারের মধ্যে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিজেদের ইচ্ছায় না গেলে জোর করে তাড়িয়ে দেয়া হবে এমন হুমকি পাচ্ছেন বাসিন্দারা। ফলে পল্লীর মানুষজন এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

প্রায় ১০০ বছর আগে সাঁওতাল পূর্বপুরুষেরা এখানে বসতি গড়েন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে চলে যাওয়া স্থানীয় হিন্দু জমিদার ইন্দ্রা ধুবা জায়গাটি তাদের বসবাসের জন্য ছেড়ে দেন। এরপর থেকে কোনো বাঁধা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে এখানেই বসবাস করে আসছেন তারা।

কিন্তু বিগত ৮-১০ বছর ধরে ১ বিঘা পরিমাণ জমিটির মালিকানা দাবি করে আসছেন নগরীর চারখুটা এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যাক্তি। তার দাবি,৩০ বছর আগে ইন্দ্রা ধুবার ওয়ারিশদের কাছ থেকে তিনি ক্রয় সূত্রে মালিক।

তবে সাঁওতাল পরিবার গুলো বলছেন, ইন্দ্রা ধুবারের এদেশে কোনো ওয়ারিশ নেই। তাহলে কিভাবে তিনি জমিটি কিনতে পারেন।এটা জালিয়াতি বলে তাদের অভিযোগ।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পল্লীর কয়েকজন নারী বসে আড্ডা দিচ্ছেন। মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ।মালতি বিশ্বাস নামে এক নারী কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, আমাদের দাদা-পরদাদারা এই ভিটায় থাকতেন। এখন আমাদের উঠিয়ে দিচ্ছে। আমরা গরিব মানুষ, ভয়ে কারও কাছে বিচার চাইতেও পারছি না।

শান্ত বিশ্বাস নামের আরেক বাসিন্দা বললেন, এতদিন কেউ কোনো কাগজ দেখাতে পারেনি। এখন হঠাৎ করে কীভাবে কাগজ বানালেন, তা বুঝতে পারছি না। তারপরও আমাদের যেতে হচ্ছে।

আদিবাসীরা জানিয়েছেন, ক্ষতিপূরণের শর্তে ১৬টি পরিবারকে মোট ৩১ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর পর ভয়ভীতির মুখে কয়েকটি পরিবার সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ইতিমধ্যে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র সরে গেছে। কেউ কেউ হাতে টাকা পেয়েছেন, কেউ পাননি।

জানাগেছে,আদিবাসি পল্লীটি উচ্ছেদের জন্য সাজ্জাদ আলীর হয়ে স্থানীয় আরও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মাঠে নেমেছেন। তাদের মধ্যে শাহীন নামের এক ব্যক্তি সরাসরি ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। বলা হয়েছে, জমি ছাড়তে হবে যেকোনো মূল্যে। স্বেচ্ছায় জায়গা ছাড়লে ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা দেওয়া হবে, না হলে জোর করে উচ্ছেদ করা হবে।

আদিবাসিদের অভিযোগ, স্বেচ্ছায় ভিটে ছাড়লে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লাখ টাকা ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিছু কিছু পরিবার টাকা হাতে পেয়েছেন। তারা ইতিমধ্যে চলে গেছেন। বাকিদেরও ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবারের মধ্যে বসতভিটা ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে। সরকারি কোনো রকম নির্দেশনা ছাড়াই কেবলমাত্র ব্যক্তি প্রভাবে সাঁওতালপল্লীটি আগামী শুক্রবারের মধ্যে খালি করতে বলা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান,সাজ্জাদ আলীর একসময় চারখুটা মোড়ে একটি ছোট মুদির দোকান ব্যবসা ছিল। এখনও মুদি দোকানের ব্যবসা আছে। তবে সেটি যে খুব বড় ব্যবসা তা কিন্তু নয়। অথচ তিনি কি ভাবে বনে গেছেন শতকোটি টাকার মালিক।তা কারো বোধগম্য নয়!
স্থানীয়রা আরও জানান, সাজ্জাদ আলী সাঁওতালপল্লীর আশপাশের আরও অন্তত ৭০ থেকে ৮০ বিঘা জমি দখলে করেছেন, যার বাজারমূল্য অন্তত ৫০০ কোটি টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দা পালন বলেন, সাঁওতালপল্লীর পাশের তিন কাঠা জমি আমার, সাজ্জাদ আলী জোরপূর্বক দখলে রেখেছে। কোনোভাবে তার কাছ থেকে সেটি উদ্ধার করতে পারছি না। অথচ তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। এখন তিনি শত কোটি টাকার মালিক।

পল্লিটি উচ্ছেদ বিষয়ে সাজ্জাদ আলী বলেন, আমি জমি কিনেছি ৩০-৩২ বছর আগে। আমার ক্রয়কৃত জায়গা নিজ দখলে নিচ্ছি। যেহেতু তারা দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করছিলো তাই মানবিক কারনে তাদেরকে অনত্র যাবার জন্য কিছু নগদ অর্থ সহযোগিতা কোরছি।

তবে, স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা নোমান আলী বলেছেন ভিন্ন কথা। সাবেক এই কাউন্সিলর বলেন, আমার অফিসে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। প্রতিবার সাজ্জাদ আলী জমি কেনার দাবি করেছেন, কিন্তু কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি। হিন্দুর সম্পত্তি কীভাবে তিনি কিনলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

শতবর্ষের ভিটেমাটি হারানোর ভয়ে সাঁওতালপল্লীর মানুষজন এখন অসহায়। সরকারি কোনো নির্দেশনা ছাড়াই তাদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। স্থানীয় প্রশাসনও এখনো এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এখনো সাঁওতালপল্লীর ১৪টি পরিবার ভিটা আঁকড়ে পড়ে আছেন। মরলে এখানেই মরবেন তবুও পৈতৃক ভিটা ছেড়ে যাবেনা তারা।

একজন নারী বাসিন্দা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমরা গরিব মানুষ। ভয় দেখালে টিকতে পারি না। ভিটেমাটি ছাড়া মানে আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া।
সাঁওতালদের এক প্রবীণ বাসিন্দা আক্ষেপ করে বললেন, জীবনের সবকিছুই এখানে। এখন যদি এখান থেকে তুলে দেয়, আমরা কোথায় যাব?

আগামী শুক্রবারের পর কালের আবর্তে বিচারহীনতায় হয়তো, রাজশাহীর মানচিত্র থেকে হয়তো মুছে যাবে মোল্লাপাড়ার এই শতবর্ষী সাঁওতালপল্লী। সঙ্গে হারিয়ে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের স্মৃতি, সংস্কৃতি ও এক অমূল্য ইতিহাস।


ads



©2022 newsprobaha.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.