বুধবার | ১৩ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফিটনেসবিহীন গাড়ি, পরিবহন মালিকদের চাপে সরকারের ‘নতি স্বীকার’

ফিটনেসবিহীন গাড়ি, পরিবহন মালিকদের চাপে সরকারের ‘নতি স্বীকার’

প্রবাহ ডেস্ক: ১৪ বছর ধরে পুরোনো ও অনিরাপদ যানবাহন সড়ক থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েও সফল হয়নি সরকার। সরকারের কাজে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন ক্ষমতাধর পরিবহন মালিক ও নেতারা। সম্প্রতি ফিটনেসবিহীন গাড়ি সরাতে বিআরটিএর অভিযান শুরু হতেই পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘটের হুমকি দেয়। তাদের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করে সরকার। এভাবেই আরও একবার থমকে দাঁড়াল পরিবহন খাতের সংস্কার প্রচেষ্টা। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা শহর ও সারা দেশের মহাসড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড়, রংচটা, গ্লাস বা লাইট ভাঙা বা সিট নষ্ট হয়ে গেছে এমন মোটরযানগুলো সরাতে গত ১ জুলাই থেকে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এতে পুরোনো গাড়ির মালিকরা বেকায়দায় পড়েন। তারা পরিবহন নেতাদের উসকে দিয়ে ধর্মঘটের ডাক দেন। আগামীকাল ১২ আগস্ট থেকে এ ধর্মঘট শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ নিয়ে গতকাল ১০ আগস্ট সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বৈঠকে বসেন পরিবহন শ্রমিক-মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে। সেখানে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা নেই, এটা প্রমাণিত সত্য। লাখ লাখ গাড়ি আছে ব্যক্তি মালিকানায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো কার্যকর নীতি ও সক্ষমতা কোনোটিই সরকারের নেই। তাই সরকারকে বারবার নতি স্বীকার করতে হচ্ছে পরিবহন সিন্ডিকেটের কাছে।

দীর্ঘসময় সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো প্রভাবশালী নেতা হয়েও সড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি সরাতে পারেননি সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে, ২০২৪ সালের ২১ মার্চ তিনি বলেছিলেন, যখন বিদেশিরা বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি দেখে, তখন খুব লজ্জা হয়। ঢাকা শহরেই অনেক লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির কারখানা আছে। আমি সেগুলো নিজের চোখে দেখেছি। ঈদের আগে সেগুলোতে রং লাগাতে দেখেছি, যে রং ১০ দিনও টেকে না।

বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে সারা দেশে ৩৬৭টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এসব অভিযানে ২ হাজার ৮২৪টি মামলা করা হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয় ১২ জনকে, ডাম্পিং করা হয় ৮৪টি গাড়ি এবং জরিমানা আদায় হয় ৭১ লাখ ২৪ হাজার ৮০ টাকা।

অভিযান শুরুর পর থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। গত ২৭ জুলাই তারা ৮ দফা দাবি জানান সরকারের কাছে। এর মধ্যে রয়েছে- বাণিজ্যিক মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ ২০ ও ২৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা এবং সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর ৯৮ ও ১০৫ ধারাসহ সুপারিশকৃত ধারা সংশোধন করা। দাবি আদায়ে ১২ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে ৭২ ঘণ্টার জন্য সব ধরনের বাণিজ্যিক পরিবহন বন্ধ রাখার কর্মসূচি ঘোষণা করে তারা।

সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে একাধিকবার উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ধর্মঘটের বিষয়টি তোলেন পরিবহন নেতারা। বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও ধর্মঘটের ঘোষণা বারবার স্মরণ করিয়ে দেন তারা। ফলে সরকার একরকম বাধ্য হয় তাদের কথা শুনতে।

১০ আগস্ট পরিবহন নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, আগামী ৬০ দিনের মধ্যে অংশীজনের মতামত নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর সংশোধনীর খসড়া প্রস্তুত করা হবে।

তিনি বলেন, ইকোনমিক লাইফ-উত্তীর্ণ মোটরযান সড়ক থেকে প্রত্যাহারের সময় মালিক ও শ্রমিক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে বিষয়ে সরকার আন্তরিক। জাপানি ও ইউরোপীয় রিকন্ডিশন্ড বাণিজ্যিক যান আমদানিতে ব্যয় সাশ্রয়ের বিষয় বিবেচনা করে বাণিজ্য উপদেষ্টা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করব।

সড়ক দুর্ঘটনায় কবলিত মোটরযানের মালিক ও চালকের বিষয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিতে জননিরাপত্তা বিভাগ, বিআরটিএ, পুলিশ ও মালিক-শ্রমিক সমিতির প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক যানবাহনের অগ্রিম আয়কর প্রিজাম্পটিভ ট্যাক্সে পরিবর্তন করে দ্রুত বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ব্যবস্থা নেবে।

পরে পরিবহন নেতাদের উপস্থিতিতে শ্রমিক নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, সরকারকে জিম্মি করে দাবি আদায় করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং আইনানুগ সিদ্ধান্তে মালিক-শ্রমিকরা সহযোগিতা করবে। সরকারের উদ্যোগে পরিবহন শ্রমিক-মালিক সমিতি সর্বসম্মত হয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করছে।

পুরনো যানবাহন সড়ক থেকে অপসারণ উদ্যোগের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে সড়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এ বিষয়ে মালিকদের সরকার সময় দিয়েছিল। রমজানের জন্য কার্যক্রম স্থগিতের পর গত ১ জুলাই থেকে তা আবার শুরু হয়েছে। তবে নতুন গাড়ি না এলে যানবাহনের সংকট দেখা দিতে পারে। তাই বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। যেসব পুরনো গাড়ির একেবারেই ফিটনেস নেই, সেগুলো অপসারণে কাজ চলছে।

তিনি বলেন, গাড়ি ডাম্পিং করার জায়গা নেই এটাও একটা সীমাবদ্ধতা। এ অভিযান আমরা অব্যাহত রাখব। এমনভাবে অব্যাহত রাখব যাতে মালিক-শ্রমিক কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

পরিবহন মালিকদের ৮ দফার মধ্যে বিআরটিএ’র অভিযান স্থগিত রাখার দাবি আছে। এটি মেনে নিচ্ছেন কি না বা সরকার চাপের কাছে নত হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, আমরা চাপের কাছে নত হচ্ছি না। এটা চাপের কাছে নত হওয়ার বিষয় নয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকার নাগরিক সমাজকে মূল্যায়ন করছে না। ১০ তারিখের সভায় নাগরিক সমাজের কাউকে রাখা হয়নি বা ডাকাও হয়নি। ফলে মালিকরা একচেটিয়া সুযোগ নিয়েছে এবং সেই ফাঁদে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও পা দিলো।

মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে পরিবহন সেক্টর বদলে দেয়ার মতো কৌশলগত নেতৃত্ব আমরা পাইনি। আগের দায়িত্বশীলদের কারিগরি জ্ঞান ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দক্ষ জনবল এনে বিআরটিএ, বিআরটিসি এবং ডিটিসিএ পরিচালনা করা উচিত। তবেই পরিবহন মালিকদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা এতটাই বিশৃঙ্খল যে আমরা পরিবহন নেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। ২০০৫ সাল থেকেই কোম্পানি ভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা চালুর কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

তিনি বলেন, দেখা গেছে, যে কেউ একক মালিক হিসেবে এসেছে, তাকেই রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দেয়া হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন দিতে যারা বসে আছে, তারা যদি সিস্টেম ম্যানেজমেন্টগুলো জানত, তাহলে এই সিঙ্গেল রেজিস্ট্রেশন কোনোদিনই দিত না। বিআরটিএ-তে অপেশাদার অপরিপক্ক কতগুলো লোক বসে আছে, তারা এই সমস্যাগুলো তৈরি করেছে। সমস্যা তৈরি করতে করতে এখন মনস্টার (দানব) তৈরি করে ফেলেছে। মনস্টার তৈরি করা যায়, কিন্তু তাদের শাসন করা যায় না। আমরা এখন এই চক্করের মধ্যে পড়েছি।

ড. শামসুল হক বলেন, একটা সুযোগ ছিল যখন এই লিডাররা (পরিবহন নেতারা) বেশিরভাগ দৌড়ের মধ্যে ছিলেন। বিআরটিএ’র যারা এর সঙ্গে জড়িত, তারা সরকারকে কাজে লাগিয়ে সংস্কার করতে পারতেন। তা করেননি, কারণ তারা বিশৃঙ্খলারই সুবিধাভোগী। কেউ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা চায় না। একটা সিস্টেম ম্যানেজ করতে হলে সেটিকে ম্যানেজযোগ্য করে গড়ে তুলতে হয়।

গাড়ির ফিটনেস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০ বছর বয়স হলে গাড়ি অচল হয়ে যাবে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে ৫০ বছরও গাড়ি চলতে পারে। কিন্তু মেইনটেন্যান্স না করলে ১০ বছরেই গাড়ি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে যদি সঠিকভাবে ফিটনেস পরীক্ষা হতো, তাহলে অযোগ্য গাড়ি বাদ দেয়া যেত। বিআরটিএ ৪২টি পরীক্ষা করে, সেখানেই বলা সম্ভব কোন গাড়ি পরের বছর চলবে না। কিন্তু তারা ফিটনেস দিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু না দেখেই।


ads



©2022 newsprobaha.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.