বুধবার | ২রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ খবর :
তদবির বাণিজ্যে লাগাম টানছে সরকার, এখন থেকে সব বদলির আবেদন অনলাইনে

তদবির বাণিজ্যে লাগাম টানছে সরকার, এখন থেকে সব বদলির আবেদন অনলাইনে

প্রবাহ ডেস্ক: সরকারি কলেজের শিক্ষকদের বদলিতে দীর্ঘদিনের চর্চিত ‘ডিও লেটার’ ও ‘তদবির’ বাণিজ্যের যুগ শেষ হচ্ছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও প্রভাব খাটিয়ে বদলি ঠেকাতে এবং পুরো ব্যবস্থাকে ডিজিটাল ও নিয়মতান্ত্রিক করতে নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করেছে সরকার।

‘সরকারি কলেজের শিক্ষক বদলি/পদায়ন নীতিমালা ২০২৫’ শিরোনামের এই নীতিমালা অনুযায়ী এখন থেকে অনলাইনে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করে প্রভাষক থেকে অধ্যক্ষ সবার বদলি হবে। প্রতি তিন মাসে একবার আবেদনের সুযোগ থাকবে। সর্বোচ্চ পাঁচটি পছন্দ দেওয়া যাবে। দ্বৈত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এই নতুন নিয়মের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দীর্ঘসূত্রতার অবসান ঘটাবে বলে প্রত্যাশা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বদলির আবেদন করতে হলে নিজ নিজ পার্সোনাল ডেটা শিট (পিডিএস) হালনাগাদ করে নির্ধারিত অনলাইন ফর্ম পূরণ করতে হবে। এ আবেদন করা যাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (www.shed.gov.bd), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (www.dshe.gov.bd) কিংবা www.emis.gov.bd ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট লিংকের মাধ্যমে।

নতুনভাবে কার্যকর হওয়া বদলি নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, অনলাইন ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে পাঠানো আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। তা কাগজে লেখা হোক, ই-মেইলে পাঠানো হোক কিংবা ডিও লেটার বা রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে হোক। সব ধরনের বিকল্প আবেদন ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য করা হবে। এমন আচরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও সতর্ক করেছে মন্ত্রণালয়।

নীতিমালা অনুযায়ী, শিক্ষকরা প্রতি তিন মাসে একবার বদলির আবেদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পছন্দ হিসেবে উল্লেখ করা যাবে। সেই পছন্দের বাস্তবতা, পদসংখ্যা ও প্রশাসনিক প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে বদলির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির দায়িত্ব ভাগ:

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বদলি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে ডিজিটাল পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে। এখন থেকে বদলির আবেদন জমা পড়ার পর তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের মাধ্যমে অগ্রায়ণ করা বাধ্যতামূলক। কোনো অধ্যক্ষ আবেদন আটকে রাখতে পারবেন না।

অগ্রায়ণ শেষে আবেদন যাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অথবা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি)। প্রতি ১৫ দিন পরপর এসব আবেদন মূল্যায়ন করা হবে এবং নীতিমালার আলোকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আদেশ জারি করবে কর্তৃপক্ষ। বদলি সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছেই।

নতুন নীতিমালায় বদলি ও পদায়নের দায়িত্ব নির্দিষ্টভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির মধ্যে। ফলে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ আর থাকছে না। এখন থেকে পদের গুরুত্ব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বদলির আবেদন মূল্যায়ন ও অনুমোদন করবে।

নীতিমালা অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পদে বদলি ও পদায়নের সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঢাকা মহানগরসহ সব বিভাগীয় শহর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনভুক্ত সরকারি কলেজে এসব পদে নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতাও মন্ত্রণালয়ের।

অন্যদিকে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কলেজে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষকদের বদলি ও পদায়নের দায়িত্ব থাকবে মাউশির অধীনে।

এই দ্বৈত কাঠামো চালুর ফলে শিক্ষকরা স্পষ্টভাবে জানতে পারবেন তাদের আবেদন কোন কর্তৃপক্ষের কাছে যাচ্ছে এবং কার এখতিয়ারে সিদ্ধান্ত হচ্ছে।

নীতিমালায় কঠোর বার্তা:

নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, নন-ক্যাডার কোনো কর্মকর্তা ক্যাডার পদের জন্য বদলির আবেদন করতে পারবেন না। পাশাপাশি যেসব আবেদনকারীর পার্সোনাল ডেটা শিট (পিডিএস) হালনাগাদ নয় বা অসম্পূর্ণ, তাদের আবেদন বিবেচনায় আনা হবে না।

সরকারি কলেজগুলো থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী পদ শূন্য করে নতুনভাবে পদায়ন করার কথাও বলা হয়েছে। বদলির নামে ডিও লেটার, রাজনৈতিক সুপারিশ বা তৃতীয় পক্ষের প্রভাব বিস্তার- সবকিছুই নতুন ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে প্রশাসনিক জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন এই নীতিমালার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত তদবির ও অনিয়মের সংস্কৃতির অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। একইসঙ্গে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদন ও নির্ধারিত সময় অন্তর মূল্যায়ন চালু হওয়ায় বদলি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও বিভ্রান্তিও অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা বদলি প্রক্রিয়াকে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও নিয়মতান্ত্রিক করতে চাই। এতে শিক্ষক যেমন স্বস্তিতে থাকবেন, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাজও সহজ হবে। এই নতুন নিয়মের ফলে বদলি এখন আর ‘কাউকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া’র বিষয় নয় বরং তা একটি নিয়মতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থায় পরিণত হবে।

এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সরকারি কলেজের অনেক শিক্ষক। তারা মনে করছেন, অনলাইনভিত্তিক বদলি প্রক্রিয়া একদিকে যেমন পেশাগত ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে তদবির-নির্ভরতা ও অনিয়মের পথ রুদ্ধ করবে।

ঢাকার একটি সরকারি কলেজের সহকারী এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বদলির জন্য আগে অনেকেরই প্রভাবশালী কারও পরিচিত কি না তার ওপর নির্ভর করতে হতো। এতে অনেক সময় যোগ্যরা সুযোগ পেতেন না। এখন অনলাইনে আবেদন করতে পারায় সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছেন। এটা খুবই স্বস্তিদায়ক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

চট্টগ্রামের এক নারী প্রভাষক বলেন, ডিও লেটার বা তদবির ছাড়া বদলি হবে- এমনটা আমরা কখনো ভাবিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সত্যিই বদলি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের সময় এসেছে। আমরা আশাবাদী, সরকার এই নীতিমালার বাস্তবায়নে কঠোর ও দায়বদ্ধ থাকবে।

বদলি ও পদায়নে ডিজিটাল প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব ড. মো. মাসুদ খান রানা বলেন, এই সিদ্ধান্তকে আমরা অত্যন্ত ইতিবাচক ও সময়োপযোগী মনে করছি। সরকারি কলেজের শিক্ষক বদলি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে তদবির-নির্ভর, অনিয়মতান্ত্রিক এবং অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট চর্চা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়ার সূচনা হলো- এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

তিনি বলেন, এখন সুযোগ তৈরি হবে সেই সকল মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকদের জন্য- যারা দীর্ঘদিন ধরে নিজ নিজ অঞ্চলে থেকেও যোগ্যতার বিচারে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা শহরে বদলির সুযোগ পাননি। এটি সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত প্রশাসনিক পরিবেশ গড়ে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

শুধু নীতিমালা প্রণয়ন নয়, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কার্যকর অংশগ্রহণ এবং সমন্বয় দরকার বলে মনে করেন এই শিক্ষক নেতা। তিনি বলেন, আমাদের মতে, বদলি প্রক্রিয়ার পুরোটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মধ্যে আরও যৌথভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত। মাউশির অংশগ্রহণকে আরও বিস্তৃত করা গেলে বাস্তবিক বদলি চাহিদা, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও নীতির বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা আরও সহজ হবে। কারণ, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বোঝার জন্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু বদলির নিয়মে স্বচ্ছতা আনলেই চলবে না, একই সঙ্গে শিক্ষা ক্যাডারে যে দীর্ঘদিনের গঠনগত ও প্রশাসনিক বৈষম্য রয়েছে, সেগুলো নিরসনেও সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে। বদলি নীতিমালার মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমানতাল নিশ্চিত না হলে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হতে পারে, যা পুরো ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।


ads



©2022 newsprobaha.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.