প্রবাহ ডেস্ক: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সমুজ্জ্বল ও সুসংহত করবে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী।
বুধবার (৪ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফর নিয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
রুহুল আলম সিদ্দিকী জানান, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ১০ থেকে ১৩ জুন যুক্তরাজ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় সফরে যাচ্ছেন। সফরটি উপলক্ষে তিনি আগামী ৯ জুন লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন এবং সফর শেষে আগামী ১৪ জুন ঢাকায় ফিরবেন।
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম একটি দেশ। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম দিকের দেশগুলোর মধ্যে একটি, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় আট লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করছে, যারা বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশটি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্যও উচ্চশিক্ষার একটি পছন্দের গন্তব্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার এবং বিনিয়োগকারী দেশ। যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিকখাতে বাংলাদেশকে নিয়মিতভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে।
কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের সাথে একযোগে কাজ করে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের মতো বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায়ও যুক্তরাজ্যের সমর্থন বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
এ বিষয়াদি বিবেচনায় এই সফরটি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় ও ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আশা করছি। এগুলোর বাইরেও আরও কয়েকটি কারণে সফরটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা প্রথমবারের মতো ইউরোপের কোনো দেশে দ্বিপাক্ষিক সফরে যাচ্ছেন। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেয়। এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চলমান সংস্কার কার্যক্রম, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকারের বিষয়টি তুলে ধরা সম্ভব হবে এবং সর্বোপরি একজন নোবেলবিজয়ী ও বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার বিশ্বজুড়ে একটি স্বতন্ত্র ও ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। তার মতো একজন ব্যক্তিত্বের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যুক্তরাজ্য সফর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সমুজ্জ্বল ও সুসংহত করবে।
সফরে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লসের সাথে সাক্ষাৎ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
রুহুল আলম সিদ্দিকী জানান, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে যুক্তরাজ্যের রাজার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে রাজা চার্লসের সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি একটি সম্মানজনক কূটনৈতিক সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সফরকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের সাথে প্রধান উপদেষ্টার একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক সেক্রেটারি অব স্টেট ডেভিড ল্যামি, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতারা ও থিংক ট্যাঙ্কের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা উপদেষ্টার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন দিক উন্মোচন হয়েছে।
বৈঠকগুলোতেও বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হবে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ, জিএসপি প্লাস প্রাপ্তি, নতুন ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গতিশীল করার ক্ষেত্রে এই সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখছি। তাছাড়া শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনিময়, তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক উদ্ভাবন, মানবাধিকার, অভিবাসন, জ্বালানি ও নিরাপত্তা সহযোগিতাসহ বিভিন্নখাতে সহায়তা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
এই সফরে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতা গভীরতর করা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যুক্তরাজ্যের সহায়তা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের বিষয়গুলোও প্রাধান্য পাবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাজ্য বরাবরই আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে। এই সফরে প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং এই মানবিক সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে আরও জোরালো সমর্থন ও সহায়তা চাইবেন।
এর পাশাপাশি দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এই আলোচনাগুলো উভয় দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সফরকালে কমনওয়েলথ এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র চলাচল সংস্থার মহাসচিবরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন।
বৈঠক ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা আগামী ১১ জুন লন্ডনের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান চ্যাথম হাউসে একটি বিশেষ আলোচনায় অংশ নেবেন। এই আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবেন।
মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ, সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন এবং একটি শান্তিপূর্ণ, সৌহার্দ্যময় ও টেকসই পৃথিবী বিনির্মাণের চলমান প্রচেষ্টায় অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাজ্যের মহামান্য রাজা তৃতীয় চার্লস এ বছরের সম্মানজনক কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ডের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে মনোনীত করেছেন।
আগামী ১২ জুন লন্ডনের সেন্ট জেমস’স প্যালেসে আয়োজিতব্য এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছ থেকে এই পুরস্কার নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এটি কেবল প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও এক অসামান্য মর্যাদা ও গৌরবের অনন্য স্বীকৃতি। এই পুরস্কার বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও দৃপ্ত ও উজ্জ্বল করবে।
সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, টেকসই সম্প্রদায় গঠন, প্রায়োগিক ও বাস্তবসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও স্থাপত্যকলার লালন ও প্রসার এবং সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী উদ্যোগসমূকে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে রাজা তৃতীয় চার্লস তথা তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস ১৯৯০ সালে ‘দ্য কিংস ফাউন্ডেশন’ নামক যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়নে অনবদ্য অবদান রাখায় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব জনাব বান কি-মুনকে সম্মানসূচক কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ডয়ে ভূষিত করা হয়।
দ্য কিংস ফাউন্ডেশন তার ৩৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১১ জুন সন্ধ্যায় একটি বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন করেছে। প্রধান উপদেষ্টা এই নৈশভোজেও যোগ দেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে এই সফর বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও গভীর ও সুসংহত করবে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। দু’দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে এবং চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।