বুধবার | ১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শান্তির দেশ ভুটানে সাত দিন

শান্তির দেশ ভুটানে সাত দিন

মো: আইয়ুব আলী: দক্ষিণ এশিয়ার একটি সংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশ ভুটান। এখানকার অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে মাতৃভাষা জংখা ভাষায় ‘দুক ইয়ল‘ বা বজ্র ড্রাগনের দেশ নামে ডাকে। দেশটি ভারতীয় উপমহাদেশের হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল পশ্চিমে ভারতের সিকিম ও তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা পূর্বে অরুনাচল প্রদেশ এবং দক্ষিণে আসাম ও উত্তর বঙ্গ দ্বারা পতিষ্ঠিত।

 

ভূটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘‘ভূ-উত্থান’’ থেকে যার অর্থ উচু ভূমি। ভুটান সার্কের একটি সদস্য রাষ্ট্র এবং মালদ্বীপের পর দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ। প্রকৃতি, পরিবেশ, অর্থনিতি, চিকিৎসা,শান্তি সব মিলিয়ে ভুটানকে এশিয়া সুইজারল্যান্ড বলা হয়ে থাকে।

 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হবার সুবাদে সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তত্বাবধানে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত দিন ভুটান দেশটি দেখা, তাদের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দর্শন ও কিছু ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের সূযোগ হয়েিেছল। “Classroom based Teaching-Learning Program and Student Evaluation Process” এই শিরোনামে আমরা বিশজন প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষক ও বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা এই সফরের সুযোগ লাভ করি।

 

২৮ নভেম্বর সকাল ৮:৩০ এ আমরা ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ভুটান এয়ার লাইন্স এর ড্রুক এয়ারে স্বপ্নের ভ্রমনে রওয়ানা হলাম। আকাশ পথে মাত্র চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আমাদের অপেক্ষার অবসান হলো। তবে এই চল্লিশ মিনিটটি ছিল স্বপ্নের মত।  হিমালয়ের কোল ঘেষে প্লেন যাওয়ার কল্যানে ছোট বড় অনেক পর্বত আর মেঘেদের ছুটে যাওয়া, প্লেনের জানালা দিয়ে দেখতে কী যে ভালো লাগছিল যা এখন শুধুই সুখ স্মৃতি।

 

সকাল ৯টা নাগাদ ভুটানের একমাত্র বিমান বন্দর পারো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছালাম। বিশাল পাহাড়ের কোল ঘেষে দাড়িয়ে আছে পারো বিমান বন্দরটি। বিমান থেকে নামার পর চারিদিক দেখে বিশ্ময়ে আবেগ ধরে রাখতে পারছিলাম না। বিমান বন্দরটির ভিতরের সোন্দর্য, ডেকোরেশন, ডিসিপ্লিন, কর্মকর্তাদের আচরন, ভদ্রতা, পরিছন্ন পোশাক, সর্বোপরি দ্রুততার সাথে চেকিং ও পাসিং আউট করানোর দক্ষতা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। আমাদের জন্য সুন্দর একটি মিনিবাস নিয়ে একজন গাইড অপেক্ষায় ছিল।

 

আমরা বের হতেই সে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। তার পরামর্শে নিকটস্থ একটি ব্যাংক থেকে সকলে প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা ডলারে রূপান্তর করে নিলাম। এখানে যে কোনো ধরনের লেনদেন তাদের নিজস্ব কারেন্সি গুলটার্ম এবং সাথে ডলার এবং ইান্ডয়ান রূপিতে হয়ে থাকে। ছোট গ্রোসারি থেকে বড় সপিং মল, রেস্টুরেন্ট যে কোনো জায়গাতেই এই তিনটি কারেন্সির যে কোনো টিতেই প্রয়োজনীয় লেনদেন করা যায়।

 

ছোট দোকানটিতেও দেখেছি নেটসংযোগসহ ল্যাপটব বা ট্যাবে ঐ দিনের ডলারের রেট প্রদর্শনের মাধ্যমে লেনদেন করছে যা আমাকে সত্যিই অবাক করেছে। টুরিস্টদের প্রতি তারা অনেক বেশি আন্তরিক। ছোট দেশটির সবকিছু আয়োজনই যেন টুরিস্ট কেন্দ্রিক। পর্যটককে আকর্ষণ করাই যেন তাদের জাতীয় নীতির মূলমন্ত্র। রাস্তার দুই পাশে চমৎকার ডেকোরেশন করা বিল্ডিং চোখে পড়ল যার সবগুলোই দেখতে প্রায় একই রকম। সব বিল্ডিংই দুইতলা বা তিনতলা বিশিষ্ট।

 

জানতে পারলাম সরকারীভাবে তিনতলার বেশি উচু বিল্ডিং করা নিষিদ্ধ এবং দরজা-জানালা ও ছাদ কোনোভাবেই ইচ্ছেমতো বা অন্যরকম করা যাবে না। প্রায় সকল দরজা-জানালা বা ছাদে বিশেষ রকমের নকশা শোভা পাচ্ছে যা বিল্ডিংগুলোর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে। অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ের বেশ দূরে দূরে দুই-একটি করে বাড়ি শোভা পাচ্ছে। এত উঁচু উঁচু পাহাড়ের দুই একটি বাড়ির জন্য বিদ্যুতের সংযোগ আমাকে আশ্চর্য করেছে।

 

যাই হোক এই রকম অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা পর আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল অমোধারাতে পৌঁছালাম। এটি থিম্পু শহরের একটি চমৎকার হোটেল। হোটেলের লবিটি সমতলে বিশাল জায়গা জুরে আকর্ষনীয় ছিমছাম ডেকোরেশন। থাকার রুমগুলো অনেক উচুতে আঁকা-বাকাঁ পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে হয়। প্রত্যেকটা রুম অনেক প্রশস্খসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এবং প্রত্যেকটি রুমের সাথে সুন্দর ব্যালকনি যেখানে বসে পাহাড় বা শহরের দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

 

হোটেলে খেয়াল করলাম অল্পবয়সী স্মার্ট মেয়েরা অভ্যর্থনা থেকে অন্যান্য কাজ করছে। দুই একজনের সাথে কথা বলে জানলাম তারা সবাই ছাত্রী। এখানে তারা পার্টটাইম চাকুরী করে নিজের পড়ালেখার খরচসহ পরিবারকেও সহায়তা করে। বিকেলে শহর দেখতে সেই সাথে কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যা লক্ষ করলাম তাতে মনে হলো রাস্তার ধারের আকর্ষনীয় বিল্ডিংগুলো প্রায় সবই হয় হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নয়তো অফিস বা সপিংমল। মানুষের বসবাসের বাড়িগুলো রাস্তার ধারে নয়।

 

মূল রাস্তা থেকে ভিতরে পাহাড়ের উচু জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মূল শহরে রাস্তার একপাশ দিয়ে সারি সারি হ্যান্ডিক্রাষ্টের দোকান চোখে পড়ল যেগুলো পরিচালনা করছে অল্পবয়সী মেয়েরা। আমাদের দেশের বিভিন্ন মেলাতে যেধরনের অস্থায়ী স্টল দেখা যায় দোকানগুলো অনেকটা সেরকম। আলাপ-চারিতায় বুঝলাম এরাও প্রায় সবাই স্টুডেন্ট।

 

নিজেদের তৈরী বা পরিবারের তৈরী জিনিসপত্র বিক্রিই অনেকেরই সংসারের মূল আয় সেই সাথে নিজেদের লোখাপড়ার খরচও এই দোকান থেকেই হয়। পরের দিন নিকটস্থ একটি স্কুল পরিদর্শনে গেলাম। স্কুলটির নাম Rinchen Kuenphen Primary School. দিনটি ছিল Teacher Parents Exam paper Collection Day  তাই আমাদের সেভাবে পরিদর্শনের অনুমতি না মিললেও সংক্ষিপ্ত আলাপ-চরিতায় বা দেখে যা বুঝলাম।

 

শীতকালে নভেম্বর-ফেব্রুয়ারী প্রায় তিনমাস বিদ্যালয় বন্ধ থাকে। লেখা-পড়ার যাবতীয় খরচ সরকার বহন করে। বই-খাতা এমনকী পরীক্ষার ফিও ছাত্রদের দিতে হয় না। ক্লাসের ছাত্রদের দিলে বিভক্ত করে বিদ্যালয়ের ভিতরে বা বাইরে কিছু পরিমান জায়গা ঘিরে দিয়ে ফুল ফলের বাগানের প্রজেক্ট দেওয়া হয়। সকলেই উৎসাহের সাথে সেগুলো পরিচর্যাও করে।

 

স্কুলের গেটে ঢুকতেই কতগুলো পাথর নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তাতে একটি ইংরেজি বাক্য চোখে পড়ল যেটি আজও আমার মনে গেঁথে আছে।“If you are not willing to learn, no one can help you. If you are willing to learn, no one can stop you”  স্কুলটিতে দেখলাম অনেক ইন্ডিয়ান শিক্ষকতা করছেন। দুই এক জন ছাত্রের সাথে কথা বলে দেখলাম তারা ইংরেজিতে বিশেষ করে স্পোকেন ইংলিশে খুবই ভালো। কোনো রকম জড়তা ছাড়াই ফাইভ-সিক্সে পড়ুয়া ছাত্ররা আমাদের সাথে ইংরেজিতে কথোপকোথন চালিয়ে গেল।

 

এখানে আমাদের ছাত্রদের সাথে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য চোখে পড়ল। আরও দুইটা স্কুল ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখার সুযোগ হয়েছিল। সবগুলোই বেশ পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। ক্লাসরুমগুলো ছাত্রদের বিভিন্ন দলীয় ও একক কাজ দ্বারা সাজানো যা যে কাওকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। ভ্রমনের এই সাতদিনে আমরা ভুটানের সর্বোচ্চ বৌধ্য মন্দির যা সমতল ভূমি থেকে ৫১ মিটার উঁচুতে অবস্থিত সহ অনেক ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় গুরত্বপূর্ণ স্থাপনা, জাতীয় পার্ক, বাংলাদেশ এমবেসি, ডাচুলা পাস যা ৩১৫০ মিটার উচু সি লেভেল থেকে। এখানে ১০৮ টি স্টুপা রয়েছে। তখন সেখানকার তাপমাত্রা ছিল মাত্র ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস ।

 

 

বিকেলে বিখ্যাত পুংখ্যদুর্গ পরিদর্শনের সূযোগ হয়েছিল। দুর্গটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিখ্যাত এই কারনে যে ১৭৩৭ সালে নির্মিত দুর্গটিতে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি চুক্তি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভুটান এবং ইন্ডিয়া ভুটান সম্পন্ন হয়েছিল। দুর্গটেিত যেতে আমাদের ভুটানের একমাত্র পারো নদী পার হয়ে যেতে হলো। সামান্য প্রশস্থ নদীটির স্বচ্ছ টলটলে পানি আমাদের অবাক করল যার নিচের ছোট মাছ, ছোট ছোট নূরী পাথরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়, পার্ক, রাস্তার পাশে প্লাস্টিকের বড় বড় সুন্দর ডাস্টবিনের গায়ে লেখা  ‘save the nature’  আমার দৃষ্টিকে আর্কষন করল।

 

ডাস্টবিনের ভেতর ছাড়া কোথাও কোনো কাগজ বা প্লাস্টিক পণ্য পড়ে থাকতে দেখলাম না। সাতদিনের সফরে একদিনও কোনো গাড়ির হর্ণ শুনতে না পেয়ে ড্রাইভারকে কৌতূহলবশত তাদরে গাড়িতে হর্ন আছে কিনা জানতে চাইলে সে হর্ন বাজিয়ে শোনান। কোথাও কোন ট্রাফকি পুলশি দখেতে পাইনি এবং কোন ট্রাফকি জ্যামও দেখিনি। সবাই জেব্রাক্রসিং দিয়েই নিয়ম মেনে রাস্তা পার হচ্ছে জেব্রাক্রসিং এর কাছে কাউকে দেখতে পেলে  চালক নিজেই গাড়ি থামিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করছে রাস্তা পার হয়ে যেতে তারপর সে গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদরে দেশ যা শুধুমাত্রই কল্পনা। সভা-সমাবশে বা কালচারাল অনুষ্ঠানরে জন্য শহরে একটি জায়গা নির্ধারিতে আছে।

 

রাস্তা বন্ধ করে তার উপর জনসভা তারা কল্পনাও করে না। চলাচলরে সময় রাস্তার দুই দুই দিকে জমিতে আপলে কমলার  বানিজ্যিত চাষ চোখে পড়ল। চাল গম সবজি পেঁয়াজ মরিচের জন্য প্রায় সর্ম্পূণ ভারতরে উপর নির্ভরশীল। অনেক দোকানিকে ঢাকার বঙ্গ বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করতে শুনে ভালো লাগলো। শীতরে পোশাক দামি কম্বল ইলকেট্রনিক পণ্যের সিংহভাগ চীন থেকে আসে বলে মনে হল। আসলে সব দিক থেকে ভুটান দুই দিকে দুই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ ভারত ও চীনের স্যান্ডউইচ রাষ্ট্র’ বলে মনে হল।

 

অনেক ভালো লাগার মধ্যে দেশের একমাত্র মসজিদটি দুই বছরের অধকি সময় ধরে বন্ধ থাকার খবর মনটা খারাপ হয়েছিল। যে অভিজ্ঞতাটি না বললে আমার এই ভ্রমণ কাহিনী সত্যিই অসর্ম্পূণ থেকে যাবে তা হল একদনি বিকেলে সিডিউল ভ্রমণ সেরে কছিু শপিং করে হোটেলের লবিতে এক সোফায় বসে রেস্ট নেওয়ার পর আমার ল্যাপটপ ও শপিং ব্যাগ গুলো সোফায় রেখে রুমে চলে যায়।

 

তারপর ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার পর আবার একটু ঘুরাঘুরি করে ফিরে ডিনার করে রুমে ফিরে রাত ৯ টার পর ল্যাপটপ খোঁজ করলে না পেয়ে হোটেলের লবির সইে সোফায় গিয়ে দেখি যে ল্যাপটপসহ আমার সকল মালামাল সেখানে যেমন ছিল তেমনি আছে অথচ কোথাও কোন সিসিটিভি ক্যামেরা নাই। জিনিসগুলো ফিরে পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার দেশ হলে কি হতো মনের ভিতরে উঁকি দিতে লাগল। যাই হোক অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে জীবনের সেরা একটি ভ্রমণ শেষে ৩ ডিসেম্বর আমরা দেশে ফিরলাম।

 

ফিরে এয়ারপোর্টে গাড়ি পেতেই আধা ঘন্টা রাস্তার উপর অপেক্ষা তারপর রাস্তায় তীব্র যানজট আমার স্বপ্নের ভ্রমণের ঘুম ভাঙ্গলো। অনেকে অপ্রাপ্তির মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এটি ছিল আমার জন্য এক বড় প্রাপ্তি ও সম্মান। শিক্ষকদের জন্য এ ধরনের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করলে এবং শিক্ষকগণ তাঁদের লব্ধ জ্ঞান নিজ নিজ র্কম ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন হবে বলে আমি বশ্বিাস করি।

 

লেখক : মো: আইয়ুব আলী, প্রধান শিক্ষক, ঘোড়ামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বোয়ালিয়া,রাজশাহী

 


©2022 newsprobaha.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.