নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী মহানগরীর বর্ণালীর মোড়ে অবস্থিত মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন “রাজশাহী সদর মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে” চলছে প্রকাশ্য পুকুর চুরি। অভিযোগ রয়েছে, এ চুরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত খামারের ব্যবস্থাপক ফরিদুল ইসলাম। আর এই চুরির ভাগ পাচ্ছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।
মৎস রেনুপোনা ক্রয়কারীদের তথ্যের ভিত্তিতে ১৯ মে, সকাল ৭টায় বিভিন্ন জাতের মাছের রেণু পোনা বিক্রির সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন কয়েকজন সংবাদকর্মী। সে সময় ক্রেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির চিত্র।
দারুশা থেকে আসা মৎস্যচাষী বাবু জানান, তিনি মিরকা, সিলভার কার্প ও রুই মাছের রেণু পোনা কিনেছেন। মিরকা ও সিলভার কার্প প্রতি কেজি ৩ হাজার টাকায় এবং রুই ৪ হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন। রশিদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সাদা কাগজে হাতে লেখা একটা চিরকুট দিয়েছিল, পোনা নেয়ার পর সেটা রেখে দিয়েছে।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে আসা চাষী জয়নাল আবেদিন বলেন, তিনি রুই, মিরকা ও বাটা মাছের রেণু পোনা কিনেছেন, প্রতি কেজি ৪ হাজার টাকা দরে রুই ও বাটা এবং ৩ হাজার টাকা দরে মিরকা। তিনি একটি হাতে লেখা সাদা কাগজের চিরকুট দেখান, যাতে মাছের নাম ও পরিমাণ লেখা রয়েছে। তিনি জানান, “কখনো ছাপানো কোনো সরকারি রশিদ পাইনি।”
নওগাঁর নিয়ামতপুর থেকে আসা আরেক চাষী জিয়াউল হক জানান, তিনি রুই, কাতলা, মৃগেল ও সিলভার কার্পের রেণু পোনা কিনেছেন। প্রতি কেজি রুই ও কাতলা ৪ হাজার টাকায় এবং মৃগেল ও সিলভার কার্প ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। তিনি বলেন, “বছরের পর বছর এখান থেকে পোনা নিচ্ছি, কিন্তু কখনো সরকার নির্ধারিত দামের তালিকা দেখিনি বা সরকারি রশিদ পাইনি।”
খামারের অভ্যন্তরে অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোথাও সরকার নির্ধারিত দামের তালিকা টাঙানো নেই। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কাইয়ুম নামে এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, যিনি দুই বছর আগে অবসর নিয়েছেন। তিনি বলেন, “স্যার ডাকে তাই সহযোগিতা করতে আসি।” তবে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিনি এই চুরির কাজে ‘পোনা এক্সপার্ট’ হিসেবে পরিচিত এবং পারিশ্রমিক নিয়েই আসেন।
খামারসূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কেজি রেণু পোনা বিক্রি হলেও, সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে মাত্র ৫ থেকে ৭ কেজির দাম। ফরিদুল ইসলামের ডান ও বাঁ হাত হিসেবে কাজ করেন কাইয়ুম ও তরিকুল। এই চুরির অর্থের ভাগ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এবং উর্ধ্বতন কতিপয় কর্মকর্তার কাছেও পৌঁছায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজশাহী মৎস্য ভবনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারি কোষাগার বঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব । চাষীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে অস্বাভাবিক বেশি দাম। তারা জানান, যোগদানের পর থেকেই ফরিদুল ইসলাম উপরের দু-একজনকে ম্যানেজ করে এই অনিয়ম-দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। প্রতি মাসে মা মাছ সংরক্ষণের পুকুর থেকেও লক্ষাধিক টাকার মাছ বিক্রি হয় রাজশাহীর পাইকারি বাজারে, যার কোনো হিসাব সরকারি নথিতে নেই।
তারা আরও জানান, এর আগেও দুইজন কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর প্রচার হলেও কোনো সাজা না দিয়ে কেবল বদলি করা হয়েছিল। তাই ফরিদুল ইসলামও নিশ্চিন্তে একই পথে হাঁটছেন।
সরকার নির্ধারিত দামের তালিকা কেন নেই? এ প্রশ্নের উত্তরে খামার ব্যবস্থাপক ফরিদুল ইসলাম বলেন, “সব কিছু তালিকা দিয়ে চলে না, এটা আপনারাও বোঝেন আমিও বুঝি। দাম সময় অনুযায়ী পরিবর্তন হয়।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “সব তথ্য-প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।” তবে বক্তব্য চাইলে তিনি বলেন, “আমার জানা মতে এখানে এ ধরনের কোনো অপরাধ হওয়ার কথা নয়। তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।” সরকার নির্ধারিত দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, “এটা আমার জানা নাই, ফরিদুল সাহেবের কাছে জেনে নিন।”
এ বিষয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আফিয়া আকতার’র সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।