নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা। গত শনিবার ও তার আগের ২৪ ঘণ্টায় পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী মিলে ৭টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে রেলপথের ত্রুটি দৃশ্যমান হওয়ায় চলাচলরত ট্রেনগুলো ডি-রেইল হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আর এসব ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা দিয়েছে রেল প্রশাসন।
তীব্র গরমের কারণে রেললাইনের পাত বেঁকে যাওয়া কিংবা রেললাইনে কোনো ত্রুটির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না সে প্রশ্নই সামনে আসছে। সেই সঙ্গে রেললাইন নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ ও দায়সারাভাবে সংস্কারকাজ, যথাযথ তদারকির অভাবও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে। তবে লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা তদন্তে রেলের পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় জাহানাবাদ এক্সপ্রেস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে কনটেইনারবাহী ট্রেন ও কক্সবাজার এক্সপ্রেস গত শনিবার লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় বিভিন্ন রুটে শিডিউল বিপর্যয়সহ বেশ কয়েকটি ট্রেনের যাত্রা বাতিলের মতো ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি বেশকিছু ট্রেন সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতেও ব্যর্থ হয়। একদিনের মধ্যে একাধিক ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে কয়েক দিন লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছে রেলওয়ের পরিবহন বিভাগ।
জানা গেছে, ৯মে শুক্রবার রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া খুলনাগামী জাহানাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ফরিদপুরের ভাঙ্গার বামনকান্দা জংশন এলাকায় লাইনচ্যুত হয়। একই দিন রাত ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের পৈরতলা লেভেল ক্রসিংয়ের পাশে লাইনচ্যুত হয় চট্টগ্রাম থেকে আসা পণ্যবাহী একটি কমিউটার ট্রেনের বগি। রাতে সে ট্রেনটি উদ্ধার শেষ করলে সকালে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদেশে ছেড়ে যাওয়া কক্সবাজার এক্সপ্রেসওয়ে ট্রেনটি একই জায়গায় লাইনচ্যুত হয়। শনিবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল স্টেশনে লাইনচ্যুত হয় তেলবাহী ট্রেনের লোকো। একই দিন বেলা আড়াইটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলওয়ে জংশন ইয়ার্ডে পণ্যবাহী কনটেইনার ট্রেনের দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
এদিকে জাহানাবাদ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পয়েন্টম্যান নজরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে অন্য ট্রেনগুলো লাইনচ্যুতির ঘটনায়ও।
রেল-সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রেনগুলো লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে জাহানাবাদ এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি একদমই নতুন। এ ট্রেনগুলো চলাচল করে দেশের সবচেয়ে ভালো ট্র্যাকগুলোয়। কিন্তু সাম্প্রতিক দাবদাহের কারণে রেলপথে ত্রুটির কারণে ট্রেনগুলো লাইন থেকে ছিটকে পড়ে। দেশের মিটার গেজ ট্রেনগুলো সর্বোচ্চ ৭০-৭৫ কিলোমিটার গতিবেগে চলাচল করলেও ব্রড গেজ ট্রেন চলাচল করে ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে। এতে রেললাইনে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। পাশাপাশি এখন তীব্র গরম চলছে। এসব কারণে রেললাইনে ত্রুটি বাড়তে পারে।
তাছাড়া সারা দেশে গরমের তীব্রতা বাড়লেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড কিন্তু ছাড়ায়নি। ফলে এখনই যদি রেললাইন থেকে ট্রেন ছিটকে পড়ার ঘটনা ঘটে তাপমাত্রা আরও বাড়লে রেললাইনের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। তাই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখার পাশাপাশি গভীর তদন্ত করে কারণ অনুসন্ধান জরুরি। এছাড়া কনটেইনারবাহী একটি ট্রেন ও জ্বালানি তেলবাহী ট্যাঙ্কার দুটি কী কারণে লাইনচ্যুত হলো সেগুলোও বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, সঠিকভাবে টেম্পিং না করা, স্লিপারের ক্লিপ থাকা না থাকা, চাকার ট্রলি ঠিক ছিল কিনা, ওভারলোড বা ওভারস্পিড ছিল কিনা, কারো দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা বা গরমের কারণে লাইন বেঁকে গিয়েছিল কিনা সবকিছুই খুঁজে দেখতে হবে। তাছাড়া রেলওয়ের বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিম্নপদের কর্মীদের ওপর দায় চাপিয়ে প্রকৃত কারণকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। অধিকাংশ সময়ই তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না। দুর্ঘটনার পর একটি ডিপার্টমেন্ট অন্য একটি ডিপার্টমেন্টের ওপর দায় চাপিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে। এভাবে দায় চাপিয়ে দায়মুক্তির চেষ্টা না করে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান না করলে রেলপথে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।
রেল সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, লাইনচ্যুত হওয়া ট্রেনগুলোর অধিকাংশই পণ্যবাহী। অতিরিক্ত লোডের কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। সম্প্রতি কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটে যাওয়া ট্রেন দুর্ঘটনাগুলো কোনোভাবেই তা হালকা মনে করার কারণ নেই। এসবের কারণে শিডিউল বিপর্যয়, জ্বালানি অপচয়, যাত্রী ভোগান্তি, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সিওপিএস আহাসান আলী ভুঁইয়া বলেন, রেলের ‘পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে পরপর বেশ কয়েকটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। বেশির ভাগই পণ্যবাহী ট্রেন হওয়ায় যাত্রী হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া সম্প্রতি রাজশাহী ইয়ার্ডে, রাজশাহী রেলস্টশনে, আড়ানীতেও ট্রেন দুর্ঘটনায় পতিত হয়। দেশে দাবদাহ চললেও ঠিক কোন কারণে একাধিক ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে তা এখনই নির্ণয় করা যাচ্ছে না। তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে হঠাৎ একাধিক দুর্ঘটনার কারণে ট্রেন চলাচলে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’