শনিবার | ১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ খবর :
রেললাইন সংস্কারে গাফেলতি-কতৃপক্ষের উদাসীনতার কারনে ঘটছে ঘনঘন ট্রেন দূর্ঘটনা পবায় দুই ইউনিয়নে সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটরদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন আম উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও রপ্তানিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ মার্কো-জেডির ৪৮ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পারমাণবিক অস্ত্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি সভার আহ্বান শেহবাজের আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগানে উত্তাল শাহবাগ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে সরকার রাজশাহী মহানগরীতে বিশেষ অভিযানে ২ জনসহ গ্রেপ্তার ২০ রাসিকের সাবেক মেয়রের এপিএস নওগাঁ থেকে গ্রেপ্তার
রেললাইন সংস্কারে গাফেলতি-কতৃপক্ষের উদাসীনতার কারনে ঘটছে ঘনঘন ট্রেন দূর্ঘটনা

রেললাইন সংস্কারে গাফেলতি-কতৃপক্ষের উদাসীনতার কারনে ঘটছে ঘনঘন ট্রেন দূর্ঘটনা

নিজস্ব প্রতিবেদক: মাত্র ২০ ঘন্টার মধ্যে পাঁচটি ট্রেন দূর্ঘনা ঘটেছে রেলওয়েতে। দূর্ঘটনা গুলো ঘটেছে ৯ মে রাত থেকে ১০ মে দুপুরের মধ্যে। দূর্ঘটনা কবলিত ট্রেন গুলো হচ্ছে, রাতে ভাঙ্গা জংশনে খুলনা অভিমুখী জাহানাবাদ এক্সপ্রেস ডিরেইল, ঐ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিটিও এবং পরবর্তীতে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ডিরেইল, শ্রীমঙ্গলে ৯৬২ বিটিও ডিরেইল, আখাউড়ায় আপ বিটিও ডিরেইল।

এছাড়া ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসেই ২৫দিনেই ১২টির বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটে। আর কত দূর্ঘটনা ঘটলে টনক নড়বে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এর দায়ভার কে নিবেন, প্রকৌশলী বিভাগ, মেকানিকাল বিভাগ, অপারেটিং বিভাগ।
আগের যে পুরানো রেল লাইনগুলো রয়েছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা, লাইনের নিচে পাথর দেওয়া, উপযুক্ত বগি ও কোচ কেনা। যে ইঞ্জিন দিয়ে রেল চলে তার প্রায় ৭০ শতাংশেরই মেয়াদ নেই। একই অবস্থা কোচের ক্ষেত্রে। এই জায়গাগুলোতে রিপ্লেস দরকার ছিল। এসব কাজ যাত্রী সেবার অন্যতম উদ্যোগ। এসব উদ্যোগ না নিয়ে মনযোগ দেওয়া হয়েছে লাইন সম্প্রসারণে।

এছাড়া আয় আগে, পরে ব্যয় নীতি পরিহার রেলের। বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষেত্রে ব্যয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আগে, পরে আয়ের কথা চিন্তা করা হয়েছে। এর ফলে টেকসই কাজের পরিবর্তে হয় নিম্ন মানের কাজ আর প্রতিটি প্রক্লল্প বাস্তবায়নে হচ্ছে পুকুর চুরি।

ঘন ঘন লাইনচ্যুতির কারন হিসেবে রেল কতৃপক্ষ বলছেন, রেললাইনের ত্রুটি, পুরোনো স্লিপার, ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগিতে ত্রুটি, নির্ধারিত গতিসীমার চেয়ে বেশি গতিতে ট্রেন চালানো, ভারী বৃষ্টির কারণে মাটি নরম হয়ে রেলপথ দেবে যাওয়া, ঠান্ডা ও গরমে রেল সংকুচিত ও সম্প্রসারনের কারণে ঘনঘন ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। তবে,এর জন্য জনবল সংকটকে দায়ী করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পু্রোনো লাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন আর রক্ষণাবেক্ষণই এর জন্য দায়ী। তথ্যানুযায়ী, দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ৯৪৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করেছে। এসব রেলপথে আড়াই হাজার অর্থাৎ ২ হাজার ৫৪১টি রেলক্রসিং আছে। সে হিসেবে রেললাইনের প্রায় প্রতি কিলোমিটারে একটা করে লেভেল ক্রসিং থাকার কথা। আর এসব রেল ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশে কোনো গেট নেই বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ট্রেন চলাচলে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই বগি ও ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে। এ ছাড়া অপারেশন ঘাটতির বিষয়টিও দুর্ঘটনার অনুসন্ধানে সামনে এসেছে। যোগাযোগ ও দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণও এর জন্য দায়ী।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে রেললাইনের ভিত ঠিক থাকে না। ভিতের লেভেল ঠিক রাখার জন্য লাইনের নিচে যে উপাদানগুলো থাকে সেগুলো যথাসময়ে পরিবর্তন করা হয় না। যেগুলো প্রায় জোড়া তালি দিয়ে রাখা হয়। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। লেভেল ক্রসিংও অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ।’

এই প্রকৌকশলীর সাথে একমত খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তারাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা( প্রকৌকশলী) বলেন, ‘মূলত পুরোনো লাইন, দুর্বল রেল, কম স্লিপার, লাইনের অ্যালাইনমেন্ট ঠিক না থাকা, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর ও ফিস প্লেট না থাকা; সর্বোপরি দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বগি লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রেললাইনে সিগন্যাল ত্রুটিও রয়েছে। আবার ভুল সিগন্যাল দেওয়াও ট্রেন লাইনচ্যুতির কারণ। অনেকসময় চালক সিগন্যাল অমান্য করে থাকে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এগুলো নিয়ে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু কিছু অসাধু কর্মকর্তার গাফলতির কারণে এসব সমস্যার সমাধান করা যায়নি।’

রেলওয়ের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রেল ইঞ্জিনের সংখ্যা ছিল ৪৪২টির মতো। বর্তমানে এই সংখ্যা ২৬৩টি। এই ইঞ্জিনের মধ্যে ১৮০টি অর্থাৎ প্রায় ৬৭ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। ৫৪ বছরের পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় ইঞ্জিন দিয়েও চলছে রেল। এতে প্রতি বছর দুর্ঘটনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে ট্রেনের গতি।

এই গতি টেনে তুলতে এক সময় সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা রেল বিভাগকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সড়ক যোগাযোগ থেকে আলাদা করে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করে। নতুন মন্ত্রণালয় গঠনের পর থেকে গত ১২ বছরে রেলের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পও নেওয়া হয় বেশিকিছু। যার অধিকাংশই ছিল অবকাঠামো খাতে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন লাইন নির্মাণ ও লোকমোটিভ কেনার দিকেও সরকারের নজর ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের পাশাপাশি যদি পুরনো লাইন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হতো তাহলে আজ এত দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমাদের রেল যেভাবে চলার কথা সেভাবে চলছে না। বর্তমানে যারা রেল পরিচালনা করছেন, তারা সরকারের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকার রেলকে বেহিসাবি টাকা দিচ্ছে, বড় বড় প্রকল্প দিচ্ছে। টাকার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য করছে না। কিন্তু রেল সঠিকভাবে পরিকল্পনা নিতে পারছে না। যে কারণে আজ এই পরিস্থিতি।’

২০১১ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের পর ২০১২ সাল থেকে সরকারের উন্নয়ন বাজেটে যুক্ত হয় তারা। নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। রেলপথকে ঢেলে সাজাতে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণের পাশাপাশি সিঙ্গেল লাইনকে ডাবল, সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন, নতুন নতুন স্টেশন, নতুন ইঞ্জিন ক্রয়, কোচ ক্রয়ের জন্য নেওয়া হয় আলাদা আলাদা প্রকল্প। রেলওয়ে বলছে, গত ১২ বছরে প্রায় অর্ধশত প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেলওয়ে। যার সিংহভাগই চলমান। তবে তা চলছে কচ্ছপ গতিতে। বর্তমানে রেলওয়ের হাতে প্রকল্প আছে ২৮টির মতো। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগের-ই মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি বেড়েছে ব্যয়ও।

তিনি আরও বলেন, ‘সবার আগে দরকার ছিল, যে লাইনগুলো রয়েছে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা, লাইনের নিচে পাথর দেওয়া, উপযুক্ত বগি ও কোচ কেনা। যে ইঞ্জিন দিয়ে রেল চলে তার প্রায় ৭০ শতাংশেরই মেয়াদ নেই। একই অবস্থা কোচের ক্ষেত্রে। এই জায়গাগুলোতে রিপ্লেস দরকার ছিল। এসব কাজ যাত্রী সেবার অন্যতম উদ্যোগ। এসব উদ্যোগ না নিয়ে মনযোগ দেওয়া হয়েছে লাইন সম্প্রসারণে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দরকার ছিল আয় আগে, পরে ব্যয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষেত্রে ব্যয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আগে, পরে আয়ের কথা চিন্তা করা হয়েছে। আর এই আয়ের কথা চিন্তা করে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। ফলে যাত্রীরা হচ্ছেন রেল বিমুখ।’

ট্রেন একটা আর্টিকুলেটেড জোড়া লাগানো গাড়ি। এটিতে হঠাৎ ব্রেক করা যায় না। কারণ, এতে যাত্রীরা ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এ কারণেই ট্রেনের নীতিমালায় বলা আছে যে, রেল ট্র্যাকের ১০ ফুটের মধ্যে সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে অলিখিতভাবে। কেউ তার আশেপাশে আসতে পারবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র এর উল্টো। রেলের জমিতে হাট-বাজার, বসতি বানিয়ে রেললাইনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। দুর্ঘটনা রোধে এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় বড় গণপরিবহন রেলওয়ে। যাতায়াতে সবচেয়ে নিরাপদ যানবাহন হিসেবে রেলকেই বেছে নেয় মানুষ। কিন্তু, সারা বিশ্বে রেলকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশে সবসময় রেল থেকেছে অবহেলিত।


ads



©2022 newsprobaha.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.